#দিনেশ_সিংহ_রায়, আমার দেখা সবচে উঁচু বাংলার শিক্ষক। শারীরিক উচ্চতায়, মানসিক উচ্চতায়, গলার স্বরের উচ্চতায়, ভালবাসা-স্নেহ করার উচ্চতায়, শাসন করার উচ্চতায়। ছয় ফুটের ওপর উচ্চতার এই মানুষটি বাংলা পড়াতেন। পড়াতেনই না, গুলে খাওয়াতেন। ক্লাসের ফাকে, ক্লাসের বাইরে অনেক কথা হত। আমাকে বলতেন ভাগ্যবান, আমার বাড়ি আর মধুসূদন দত্তের বাড়ি যশোর হওয়াতে। আর দূঃখ করে বলতেন, আপসোস করে বলতেন যদি একবার সাগরদাঁড়ি আসতে পারতেন! মধুসূদনের এত ভক্ত ছিলেন তিনি! ক্লাসে মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্য থেকে পড়াবার সময় এত সুন্দর করে পড়াতেন যে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হতাম; ভাবতাম ক্লাসে আমি আছি আর প্রিয় স্যার। আর কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। আসলে ভাবতে বাধ্য হতাম, স্যার তাঁর অবচেতন মনেই আমার অবচেতন মনে এসব ভাবনা তৈরি করে ফেলতেন।
মেঘনাদ বধ কাব্য লেখার সময় মধুসূদন হঠাৎ নাকি থেমে যান, তিনি কিছুতেই মেঘনাদকে হত্যা করার ঘটনার বর্ণনা লিখতে পারছিলেন না। কোন এক বন্ধুকে অগ্যতা চিঠি লিখে বলেন, "it tears me killing meghnaad"।
মেঘনাদকে এতই ভালবাসতেন তিনি। ভালবাসবেনই না কেন! বাংলার শ্রেষ্ট বিদ্রোহী কবি মধুসূদন সমাজ ধর্মের বিরুদ্ধতা করে ভাবতেন রাম ভীরু কাপুরুষ। যুদ্ধের জন্যে এমন কেউ নেই যার থেকে সাহায্য নেয় নি রাম। ঠিক বিপরীত চরিত্রের মেঘনাদ তাই কবির মনে এত ভালবাসার আসন পেয়েছিল। মেঘনাদ বধে তাই রামের এত ছোট করে দেখানো, রামকে তথাকথিত ধুয়ে দেওয়া। সীতাকে শেষ পর্যায়ে এসে সতী প্রমাণ করতে বলার মধ্যেও কবি রামের ছোট মানসিকতার পরিচয় দেখেছেন। রামকে করেছেন কাপুরুষ, মেঘনাদকে হিরো।
সবই দিনেশ স্যারের থেকে শোনা। কখনো ক্লাসে, কখনো ক্লাসের বাইরে। কখনো স্যারদের রুমে দাবা খেলার সময়ে কথার কথা বলার সময়ে।
স্যারের দুটো বাইক ছিল। একটা টিভিএস ভিক্টর, অন্যটা রাজদূত। রোজই আসতেন টিভিএসে যার সিট কায়দা করে উঁচু করা বসার সুবিধার জন্যে। নইলে পা বেঁধে যায় যে স্যারের! আর বর্ষা কাদার দিনে আসতেন রাজদূতে চড়ে। ঠিক রাজার মতোই। এসে নেমে খানিকটা তামাক গুড়ো নাকে টেনে নিতেন। নস্যি নেওয়া বলা হয় যাকে।
একবার কিছু ছাত্র রাজনৈতিক কায়দায় স্কুলে দাবি-দাওয়া পেশ করে আর স্কুলে ঢোকার প্রধাণ দরজা আটকে অবরোধ করে, শ্লোগান দিতে থাকে। স্যার স্কুলে এসে এসব দেখে সবাইকে বোঝান, কেউ কান দেয় না। রাজপুত বংশধর হওয়ায় বোধহয় স্যারের রাগটা একটু বেশিই হয়ে যায়। সেদিন স্যার বসেছিলেন তার প্রিয় রাজদূতে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে তিনি ফিরে যান এবং মিনিট দুয়েক বাদেই ভীম গতি যাকে বলে সেই গতিতে সোজা গেটের দিকে আসতে থাকেন। কোথাকার কোন আন্দোলন সবাই পালাতে পারলে বাঁচে!
ক্লাসে স্যারকে মাথা নিচু করে সাবধানে ঢুকতে হত। সবাইকে তিনি অকৃত্রিম স্নেহ করতেন বটে তবে অন্যায় মেনে নিতেন না একচুল। আমি চলে আসার পরেও নাকি স্যার আমার কথা বলতেন। আজ কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
যা হোক, যার জন্যে প্রথম লাইন লেখা তাতে ফেরা যাক। স্যার হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন একটা ভাবসম্প্রসারণ করতে। টপিক দিলেন "চেরাপুঞ্জি, এক খন্ড মেঘ এনে দিতে পার গোবি-সাহারার বুকে?" প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। এরকম ভাবসম্প্রসারণ কখনো দেখিনি। যাকে বলে আনকমন। স্যার পরে আমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ভারতের সবচে বেশি বৃষ্টিপাত হয় কোথায়, সবচে কম বৃষ্টিপাত হয় কোথায়, গোবি কি একটা মরুভূমি নয়? আর সাহারাও?
আমি আমার ঘাবড়ে যাওয়া থেকে উতরে গেলাম। ভাবসম্প্রসারণটা স্যারকে বললাম আমতা আমতা করে। স্যার খুশি হলেন।
আমি সেদিন বুঝলাম স্যার যেন আরো একটু অন্যরকম। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও তিনি একই ভাবসম্প্রসারণে বুঝালেন। আমার তরুণ মন আনন্দে ভরে গেল।
আহঃ সেই সব দিন!
No comments:
Post a Comment