দুই বন্ধু রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। একজন ঠিক চাপা ফুটবলের মত দেখতে। নাদুসনুদুস শরীরের ওপর মাথা। কদম ছাঁটে কাটা চুল। নাম অাকাশ। পাশের জন লম্বা আর হ্যাংলা- বলতে গেলে পাটকাটি। নাম বাতাস। আকাশের সাথে তার সখ্যতার একটা সীমানা থাকা উচিত্ ছিল বলে ভাবে বাকি ক্লাসমেটরা। তাদের যে মানিকজোড় বলে ডাকে সবাই! তবে সে গুড়ে বালি। দু'জনের বন্ধুত্বের সীমানা অসীম।
ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছে দুজন। একটা স্বনামধন্য কলেজের ছাত্র তারা। বিজ্ঞান বিভাগ, একাদশ শ্রেণী।
আকাশ বেশ গম্ভীর ভাবে কথা বলে। ভাব নেয় সে সব বোঝে। অথচ ক্লাসে অনেক কিছুই তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। সিলিং ছিল বলে রক্ষে, কিছু কিছু পড়া সে বাকিদের চেয়ে ভাল বোঝে। বিপরীতে বাতাস চঞ্চল, কথার খই ফোটে মুখে কিন্তু সে অন্যকে বাচাল বলতে ভালবাসে। পড়ালেখায় সে বরাবর ভাল।
কলেজ গেটের সামনে আসতেই চায়ের দোকানে কিছু ছেলেকে তারা সিগারেট খেতে দেখে।
চল আমরা ডাবল হিটের দোকানে চা খেতে যাই- বলে উত্সুক দৃষ্টিতে বাতাসের দিকে চোখ তুলে তাকায় আকাশ।
যেতে পারি। তবে শর্ত আছে। আজ ক্লাসে ফিজিক্সটা তেমন বুঝিনি। আমাকে বুঝিয়ে দিবি। অকা?
আকাশ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ক্লাসটা তার খুবই ভাল লেগেছে। রুহুল আমিন স্যার বরাবরই ভাল পড়ান। আজকের লেকচার ছিল মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ অধ্যায় থেকে। ক্লাসের মধ্যেই সে বিশাল এই মহাবিশ্ব নিয়ে ভাবছিল।
কিরে এত কি ভাবছিস?- বলে এক টোকা দিল আকাশের মাথায়।
না, তেমন কিছু না। বেশ, চল যাই।
ডাবল হিট চায়ের দোকান। কয়েক দশকের পুরানো একটা বড় রেডিও সেট রাখা বেঞ্চের কোণায়। পাশেই দু'জন বসে। কয়েক মিনিট পর চা আসে। রহিম ভাই ছাড়া এমন চা কেউ বানাতে পারবে না বলে বরাবরের মতই দুজন মত দেয়। অতঃপর চায়ে মন।
চা মুখে দিয়ে আকাশ বলতে লাগে-
জানিস তো চা জিনিস টা জোশ। মুখে লাগলেই আমার মগজ খুলতে শুরু করে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। মগজ কোথায় তোর মুখটা খুলেছে বেশ। বকের ডিম খাস নাকি? চা পেলেই ডিম ফুটে বকবক শুরু করে সেগুলো?
বেশি বুঝিস না তো বাতাস! চা খেতে দে মন দিয়ে।
অকা বস। তাহলে ফিজিক্সের ব্যাপারটা এবার বল। স্যার বললেন অসীম কল্পনারও বাইরে। আবার বললেন পৃথিবীর আকর্ষণ বল অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। আসলে কি তাই? কিভাবে?
হতে পারে। -আকাশের গলায় নির্লিপ্ততা। চা মুখে সে গম্ভীর ভাবে বসে থাকে। বাতাস ওকে বকের ডিম খাওয়া পাবলিক বলে উপহাস করল, ওর কি রাগ দেখানো উচিত না!
ক্লিয়ার কর ভাই। আর এক কাপ পাবি। -বাতাসের চোখে-মুখে উৎসাহ।
দেখ , তুই কিন্তু উত্তর পেয়ে গেছিস বাতাস।
কিভাবে?
এই যে তুই বললি আমি যদি ব্যাপারটা বুঝাই তুই আর এক কাপ চা খাওয়াবি। এবার ধর তোর আরো প্রশ্ন জাগলো মনে। আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে চা খাওয়াতে চাইলি। এটা চলতেই থাকবে।
মানে? -বাতাস হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
ধর একটা চুম্বক নিলি পরীক্ষার জন্য। এবার চুম্বকত্ব পরীক্ষা করতে একটা সাধারণ যন্ত্র ব্যবহার করে দেখলি ঐ চুম্বকের চৌম্বকত্ব মাত্র এক মিটারের মধ্যে আবদ্ধ। কথা হচ্ছে আসলে কি তার চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তার ওটুকুই?
বাতাস নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলে।
না তোপসে। একটু গভীরে চল। ধর তোকে একটা কুড়াল দেওয়া হল ধান কাটতে। তুই পারবি ধান কাটতে?
কুড়াল দিয়ে ধান গাছ কাটা? হুর! অসম্ভব।
উহু, মোটেও অসম্ভব নয়। পারবি, তবে কাস্তের মত অত নয়।
কাস্তে দিয়েই তো ধান কাটে। সহজে বেশি ধান কাটতে পারব। কুড়ালের চেয়ে বেশিই পারব।
এরপর যদি তোকে একটা ধানকাটার যন্ত্র দেওয়া হয় , কি হবে?
আমি আরো বেশি ধান কাটতে পারব। সব থেকে বেশি।
বটে! কিন্তু এটাই সবথেকে বেশি নয় বন্ধু। এর থেকেও ভাল যন্ত্র যদি তোমায় দেওয়া যায় তবে?
ইয়ে মানে তাহলে তো আরো বেশিই কাটা যাবে বোধহয়।
এই তো ধরতে পেরেছিস। বোধহয় নয়, আসলেই বেশি ধান কাটা যাবে।
কিন্তু এর সাথে চুম্বক কাহিনীর কি সম্পর্ক?
আছে রে আছে। আচ্ছা এবার তবে আবার চুম্বকে আসা যাক।
দেখ ঐ চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র মাপার জন্য তুই যে যন্ত্রটা ব্যবহার করবি অন্যকেউ যদি তার থেকেও ভাল যন্ত্র ব্যবহার করে তবে সে কি আরো সূক্ষ পরিমাপ করতে পারবে না?
অবশ্যই।
অসীম ব্যাপারটা ঠিক তাই। সব কিছুর মধ্যেই অসীমতা রয়েছে ।
ঐ যন্ত্রগুলো যত উচ্চমানের হবে ততোই ঐ চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব দূর থেকেই অনুধাবন করা যাবে যার সীমা ঐ চৌম্বকের পৃষ্ট থেকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ক্লিয়ার?
জলের মতো ভাই!
হয়েছে এবার চায়ের অর্ডার দে। বলে আকাশ যোগ করে- আজ ক্লাসে স্যার পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের কথা বলার সময় বলেছিলেন পৃথিবীর আকর্ষণ বল অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। আমরা সঠিক ইন্স্ট্রুমেন্টের অভাবে হয়তো কোনদিন ঠিক অসীম দুরত্ব থেকে সে প্রমাণ হাতেনাতে দেখতে পাব না।
বাতাস সে কথায় কান না দিয়ে রহিম কাকাকে চায়ের অর্ডার দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আকাশের মত বন্ধু থাকলে পড়ালেখা বুঝতে চা খুব দরকারি বলে চায়ের কদরই এখন আকাশের উদাস কথাবার্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব কথা পরে শোনা যাবে বরং!